২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা ছিল নজিরবিহীন। মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে, স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত করে, নেতৃত্ব দিয়ে নারীরা প্রমাণ করেছেন এই আন্দোলন কেবল প্রতিরোধের নয়, পরিবর্তনেরও। সেই আন্দোলনের অন্যতম একজন হলেন সিনথিয়া জাহীন আয়েশা।
‘জুলাই কন্যা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা সিনথিয়া তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হামলার শিকার হন তিনি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে আহত হন, অথচ বিষয়টি পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখেন। ১৭ জুলাই কলেজ হল বন্ধ হয়ে গেলেও বাড়ি না ফিরে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বন্ধুদের আশ্রয়ে। প্রতিদিন মাঠে নামতেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে, দেশের জন্য আজই হয়তো জীবন দিতে হতে পারে।
সিনথিয়া রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই।
সম্প্রতি নিজের অভিজ্ঞতা, প্রত্যয় ও হতাশার কথাগুলো শেয়ার করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে।
বাসস : ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলেছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরে সেটা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে আপনি কখন এবং কীভাবে যুক্ত হন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেছে। আমরা যারা সামনে থেকে সরাসরি এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছি তাদের আসলে মানতে কষ্ট হয় যে, একটা বছর কেটে গেছে। আমাদের স্মৃতিগুলো এতই অমলিন যে এক বছর কীভাবে পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারছিনা। সহজভাবে যদি বলি, আন্দোলনে আমার সংযুক্ততা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে। শুরুতে যখন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয় তখন বারবার হাসিনার ফাঁদের কথা মাথায় আসছিল। কারণ যখনই সে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতো তখন কোনো না কোনো ইস্যু সামনে নিয়ে আসতো। তাই শুরুতে আমার মতো অনেকেই মনে করেছেন এটা আইওয়াশ। কারণ তখন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল যে বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের রেল লাইন যাওয়ার বিষয়টা। তাই কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করার পরে এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করি। কারা লিড দিচ্ছে, তাদের কর্মপরিকল্পনা কীভাবে এগুচ্ছে, কিংবা শিক্ষার্থীদের সংযুক্ততা কতটা- এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার পর আমি যুক্ত হই।
বাসস : জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যেকটা মুহূর্ত স্মরণীয়। তার মধ্যে কোন বিশেষ ঘটনাটি আপনার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : পুরো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অনেক ঘটনা ও স্মৃতি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ঘটনা একদমই ভোলার মতো নয়। জীবনের যেকোনো পর্যায়েও সেই স্মৃতিগুলো স্পষ্ট থাকবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৫ জুলাইয়ের ঘটনা। ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা একটি বক্তব্যে বলেছিলেন- মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা যদি সরকারি চাকরির জন্য মেধাবী না হয়, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব মেধাবী? এই বক্তব্যের মাধ্যমে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিল, তাদের সবাইকে পরোক্ষভাবে ‘রাজাকার’ বলে অপমান করা হয়। ওই রাতেই আমরা হলের তালা ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে প্রতিক্রিয়া জানাই। রাজু ভাস্কর্য সেদিন ছিল এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধের প্রতীক।
সেখান থেকেই ঘোষণা আসে- ১৫ জুলাই সারাদিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান করবো। আমাদের প্রধান দাবি ছিল শেখ হাসিনার ওই বক্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
১৫ জুলাই সকাল থেকে আমরা সেখানে অবস্থান শুরু করি। একে একে বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দেয়। দুপুরের দিকে সিদ্ধান্ত হয়- হল পাড়া এলাকা ঘুরে আবার রাজু ভাস্কর্যে ফিরব। তখন বিভিন্নভাবে খবর আসে যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে এবং আমাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে।
আমি তখন মিছিলের সামনে ছিলাম। কিন্তু পেছনের আন্দোলনকারীদের দিকে তাকিয়ে মাইক হাতে নিয়ে স্লোগান দেওয়ার জন্য উল্টো হাঁটছিলাম। মাইকে স্লোগান দিচ্ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করি সামনের সারির নেতৃস্থানীয়রা পেছনের দিকে সরে আসছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘুরে দেখি- ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র বাহিনী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে রড, হকিস্টিক, ইট-পাটকেল, মাথায় হেলমেট। তাদের আচরণ দেখে শিক্ষার্থী বলার উপায় ছিল না- বেশিরভাগই ভাড়া করা সন্ত্রাসী।
তখন আমরা কিছুটা পেছনে সরে যাই এবং বিচ্ছিন্নভাবে স্লোগান দিতে থাকি। কিন্তু দুই দিক থেকে আবারও হামলা শুরু হয়। আমরা ভিসি চত্বরের পাশে দুটি বাসের মাঝখানে আটকা পড়ি। একদিকে যেতেও পারছিলাম না। তারা সেই চিপার মধ্যে আমাদের লক্ষ্য করে বেধড়ক মারধর করে। ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। যারা আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে ছিল, মিডিয়ায় কথা বলেছে, তাদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়।
আমি সেই প্রথমবার আন্দোলনে সরাসরি শারীরিক আক্রমণের শিকার হই। আওয়ামী গুন্ডা বাহিনী কারা ছেলে বা মেয়ে তা বিবেচনায় নেয়নি- সবাইকে একইভাবে মেরেছে। আমার ক্ষেত্রেও তারা বলেছে, ‘তুই কেন সামনের সারিতে থাকিস?’ এই বলে রড দিয়ে পেটাতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে যখন তারা এভাবে পিটাচ্ছিল, তখন আমার সামনে কয়েকজন ভাইয়ের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। আমার চুল খোঁপা করা ছিল। তখন আমাকে সারা শরীরে, এমনকি মাথায়ও আঘাত করে।
আমাদের তখন সারাদেশজুড়ে সমন্বয়কারীদের কয়েকটি গ্রুপ ছিল। সেই অবস্থায় আমার বারবার মনে হচ্ছিল, যদি আমি এখানে পড়ে যাই, সেন্সলেস হয়ে যাই- তাহলে তারা শুধু মারধর করবে না, আরো কিছু করতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেই ভয় থেকেই আমি ওখান থেকে কোনোভাবে বের হওয়ার চেষ্টা করি।
একটু দৌড়ে সামনে আসার পরে আমার হাতে থাকা ফোন দিয়ে সমন্বয় গ্রুপে শুধু একটি ভয়েস মেসেজ দিতে পারি। বলি, ‘আমি এই জায়গায় আছি, কতক্ষণ সজ্ঞানে থাকতে পারব জানি না। কেউ আশেপাশে থাকলে প্লিজ সেভ মি।’ এর পরে আর কিছু মনে নেই।
পরে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। সেখানে আমাদের বড় ভাই প্রীতম, সোহাগ ভাই, রিফাত রশিদ ভাই, নাহিদ ভাইসহ আরো অনেকেই ছিলেন। তারা সবাই সেই ভয়েসগুলো পাওয়ার পর হাসপাতালে গিয়েছিলেন।
এখানে আরো একটা দুঃসহ স্মৃতি জড়িয়ে আছে- একদফা আক্রমণের পর যারা চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলেন, তাদের ওপর দ্বিতীয়বার হামলা চালানো হয়। আহত অবস্থায়ও চিকিৎসা নিতে দেওয়া হয়নি। এটা নিছক নির্যাতন নয়, নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায়। ভিসি চত্বরে সেই চিপার ভেতরের স্মৃতিগুলো আজও কাঁপিয়ে দেয়।
বাসস : আপনি বলছিলেন, অনেক সময় আপনাকে জীবিত থাকার সৌভাগ্য নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হতো। এখন কেমন আছেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে আমি দেখেছি, আমার সামনে অনেকে মারা গেছেন, আমি বেঁচে গেছি। কেউ স্পটেই মারা গেছেন। এই অভিজ্ঞতা এতটাই ট্রমাটিক যে এখনো মনে হয়- জুলাই আন্দোলনের এক বছর পার হয়েছে কিনা, তা বোঝা যায় না।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, এটা আমাদের সৌভাগ্য- আমরা বেঁচে আছি, কারণ আমাদের করার অনেক কিছু বাকি আছে। আবার কখনো মনে হয় দুর্ভাগ্য। কারণ আমরা এখনো সেই ভয়াবহতা টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
বাসস : রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনা সরকার শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। আহত করেছে হাজার হাজার মানুষ। সে অবস্থায় আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণ আপনার পরিবার কীভাবে নিয়েছিল?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : প্রথমদিকে, যখন বাংলা ব্লকের কর্মসূচি বা শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চলছিল, তখন পরিবার সমর্থন করেছিল। তারা বুঝেছিল আমরা একটি যৌক্তিক দাবির আন্দোলন করছি।
কিন্তু যখন ১৫ জুলাই আমি হামলার শিকার হই, তখন আমি আবাসিক হলে থাকতাম। বাবা-মা ঢাকায় থাকতেন না। হামলার দিন আমাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমি ১৬ জুলাই চিকিৎসা নিই, ১৭ জুলাই জোর করে হাসপাতাল থেকে বের হই। পুরো সময়টাই পরিবার কিছুই জানত না।
আমি ইচ্ছাকৃতভাবে জানাইনি, কারণ আমি জানতাম তারা ভয় পাবে। আমার নিজের মধ্যেও এক ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়েছিল- তারা আমাদের রক্ত ফেলেছে, আমরা দাবি আদায় না করে ছাড়ব না। সবচেয়ে বড় সংকট আসে ১৭ জুলাই হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। বাসায় বোঝানো যাচ্ছিল না কেন আমি বাইরে থাকছি, কেন বান্ধবীর বাসায় আছি। এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ ভাই শহীদ হওয়ার খবরটা সারা দেশের মানুষের মনে গভীর ক্ষোভ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, তাদের পরিবারের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় প্রবল ক্ষোভ। এর ফলে ১৭ জুলাইয়ের পর পরিবারগুলো আর চাইছিল না আমরা আন্দোলনে যুক্ত থাকি, রাস্তায় নামি বা সম্মুখ সারিতে থাকি।
তারা চাইছিল আমরা যেন হলে না থেকে বাসায় চলে যাই, যাতে তারা আমাদের চোখের সামনে রাখতে পারে। আমার নিজের মনে হয়েছিল- যদি বাসায় যাই, তাহলে আর আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিতে পারব না। সেজন্য হল বন্ধ হওয়ার পর বাসায় না গিয়ে এক সিনিয়র আপুর বাসায় উঠি, যেটা লালবাগে। আমার নিজ বাড়ি সাভারে হলেও আমি ওখানে যাইনি। কারণ আপুর বাসা থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।
আমার ক্যাম্পাস ছিল বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় আমাদের জোর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর ২৫ জুলাই পর্যন্ত আমি সেই লালবাগের বাসা থেকেই আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম।
এর মধ্যে ১৭ জুলাই হাসপাতাল থেকে জোর করে ছাড় নিয়ে হলে ফিরি। ওইদিন আমরা হল থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দেই। এরপর প্রশাসন আমাদের পানিসংযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে জোর করে হল থেকে বের করে দেয়।
হল সুপার, প্রভোস্ট, প্রক্টর- যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা স্পষ্ট করে বলেছিল, রাতে হলে কোনো হামলা হলে তারা কোনো দায় নেবে না। আমরা পরিবারে এসব জানাইনি, কারণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
১৮ জুলাই আমি আপুর বাসায় যাই। মা তখন বারবার ফোন করে বলছিলেন বাসায় ফিরে যেতে। তখনকার পরিস্থিতি ছিল- খোলা রাস্তায় গুলি চলছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। মা বলেছিলেন, ‘তুমি বাসা থেকে বের হলে অন্তত জানিয়ে বের হও, যাতে পরে যদি তোমার খোঁজ না পাই, লাশটা যেন কোথায় খুঁজতে হবে তা বুঝতে পারি।’
এই কথাটা আমাদের ভেতরে এক ধরনের মৃত্যু এনে দিয়েছিল। আমাদের মনে হচ্ছিল, পরিবার এই সত্যটা মেনে নিচ্ছে- আমরা হয়তো বাঁচব না। আর আমরাও এমন অবস্থায় ছিলাম, যেখান থেকে পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। কারণ আমরা এতদূর এগিয়ে এসেছি যে পিছিয়ে গেলে সেটা নিশ্চিত মৃত্যু। সামনের দিকে গেলেই হয়তো একটা সম্ভাবনা রয়েছে।
বাসস : আপনার মানসিক অবস্থাটা তখন কেমন ছিল?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে থাকে। পরিবার থেকে বারবার বলছিল যেন বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু আমরা প্রতিদিন সকালে কর্মসূচির জন্য বের হতাম এই ভেবে- হয়তো আজ বাসায় ফেরা হবে না।
প্রতিদিন সকালে বাসা ছাড়ার সময় একবার পেছনে ফিরে তাকাতাম- এই হয়তো শেষবারের মতো দেখছি। পুরো জুলাই মাসটা এভাবেই কেটেছে।
বাসস : আন্দোলনটা অনেকের কাছে এখন ট্রমা হয়েছে। আপনার মধ্যে সেরকম কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব টের পেয়েছেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকের ঘটনা। হঠাৎ করে একদিন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, গলার ভিতরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে এমন অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গলা জ্বলে গেছে।
এর আগে ১৫ জুলাই যখন হামলার শিকার হয়েছিলাম, তখন আমার হাত ও পায়ে গুরুতর আঘাত লেগেছিল। সেপ্টেম্বরে অসুস্থ হওয়ার সময় সেই জায়গাগুলো যেন আবার অবশ হয়ে যাচ্ছিল। আমি হাত-পা নড়াতে পারছিলাম না। ওই রাতে খুব খারাপ লাগছিল, পরদিন সকালেই আমি সিএমএইচ- এ যাই।
তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সিএমএইচ- এ ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হতো, আর সেখানকার চিকিৎসাও ভালো ছিল। ওখানেই আমি দ্বিতীয় দফায় চিকিৎসা নিই। চিকিৎসার পাশাপাশি, ওখানে আমাকে একজন মানসিক কাউন্সেলরের কাছে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কারণ আমার শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি, কথাবার্তা ও মানসিক পরিস্থিতি দেখে তারা মনে করেছিল মানসিক কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন আছে।
জুলাই মাসের ঘটনা এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনো অনেক সময় বিভিন্ন ভিডিও দেখি- অনেক সময় নিজেও বুঝে উঠতে পারি না কেন চোখ থেকে পানি চলে আসে। ভিডিওগুলো দেখে মনে হয়, এগুলো কেবল ভিডিও নয়, এগুলোর চেয়েও ভয়াবহ অনেক কিছু আমি নিজের চোখে দেখেছি।
আসলে পুরো জুলাইটা এখনো এক ধরনের ‘ছোট সামারি’র মতো চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। এই অনুভূতিগুলো ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমার মনে হয় না, কেউ যদি সেই সময়কে সামনে থেকে দেখে থাকে, তার পক্ষে এ অনুভূতি পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব।
বাসস : আন্দোলনের সংগঠক হিসেবেও আপনার ভূমিকা ছিল। সেটার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ২৪ জুলাইয়ের পর থেকে এই বিষয়গুলোর সাথে আমার সংযুক্ততা আরো বেড়ে যায়। আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম। যতগুলো বড় ক্রাইসিস হয়েছে- তার মধ্যে এই প্লাটফর্ম একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভূমিকা রেখেছে।
আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং মুভমেন্টে যুক্ত মানুষের সাথে নিয়মিত বসতাম। তখন ডিবির হেফাজতে ছিল- আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই, মাসুদ ভাই, রিফাত রশিদ, মাহিন ভাইসহ অনেকেই। আমাদের একটা টিম ছিল যারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় বা রাতে বসতাম। ২০-৩০ মিনিট হলেও একটা কনভার্সেশন হতো। পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে, কোথায় কিভাবে গণসংযোগ করতে হবে- এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হতো।
বাসস : ১৭ জুলাইয়ের পর যখন আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করা হলো, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? কীভাবে যোগাযোগ রাখতেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ১৬ জুলাইয়ের ঘটনার পরপরই ১৭ তারিখে সরকারের নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষকরা তখন বলছিলেন, হল খালি করার প্রমাণ সিলগালা করে প্রশাসনে পাঠাতে হবে। আমি তখন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী। বাসায় যাওয়া নিরাপদ মনে হয়নি, কারণ পরিবার ভীত ছিল। তার চেয়ে বড় কথা, বাসায় গেলে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে থাকার সুযোগ থাকত না।
তাই আমি আমার এক সিনিয়র আপুর বাসায় অবস্থান নিই। তখন শহরের অনেক জায়গায় ইন্টারনেট অফ, মোবাইল রিচার্জ বন্ধ, বিকাশ নেই। সব মিলিয়ে চরম একটি বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ তৈরি করা হয়। মনে হচ্ছিল, আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেই আন্দোলন থামিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি।
আমাদের একাধিক হোয়াটস আপ ও মেসেঞ্জার গ্রুপ আগে থেকেই তৈরি ছিল। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের কো-অর্ডিনেটররা সেখানেই যুক্ত ছিল। যখন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা ফোনে যোগাযোগ রাখতাম। যদিও তখন ফোন কলও নিরাপদ ছিল না, আবার নেটওয়ার্কও দুর্বল ছিল। তাই অনেক সময় ফিজিক্যাল মুভ করে এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে গিয়ে হাতে হাতে তথ্য পৌঁছে দিতাম।
১৮ জুলাই আমরা আজিমপুর কলোনির মোড়ে, ইডেন কলেজের সামনে সারা দিন অবস্থান করি। সারাদিন প্রায় কোনো ইন্টারনেটই ছিল না। সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরি, তখন দেখি ওয়াইফাই পর্যন্ত কাজ করছে না। এটা পূর্বনির্ধারিত ছিল, আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম ইন্টারনেট বন্ধ হতে পারে। তাই অনেকে আগেই ভিপিএন ডাউনলোড করে রেখেছিলাম।
সেদিন ফোনে রিচার্জ করাও অসম্ভব ছিল। নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ থাকায় আমরা বিকল্প হিসেবে আবার ফিজিক্যাল মুভ করে যোগাযোগ শুরু করি। যেমন আজিমপুর থেকে কেউ নীলক্ষেতে গিয়ে বলে দিচ্ছে- সেখান কেউ আবার শাহবাগে গিয়ে জানাচ্ছে।
এইভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে, সরকারের সমস্ত বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা ব্যর্থ করে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাই।
বাসস : ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে নাহিদ ইসলাম যখন শেখ হাসিনার পতনের এক দফা ঘোষণা করেছেন তখন আপনি উনার খুব কাছেই ছিলেন। আপনার সেদিনের অভিজ্ঞতা কী?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ১ আগস্ট থেকেই ছাত্রসমাজের মধ্যে এক দফা- ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ’- একটা আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ৩ আগস্ট হয়, কিন্তু এর আগেই মাঠে-ময়দানে, স্লোগানে স্লোগানে এক দফা ছড়িয়ে পড়ে।
আমি তখন রায়েরবাগে অবস্থান করছিলাম। ২৫ জুলাইইয়ের পর থেকে আমাকে ট্র্যাক করা হচ্ছিল- নিরাপত্তা বাহিনী থেকে আমার ছবি ভাইরাল হবার পর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজা হচ্ছিল। এমনকি আমার মৃত্যুর গুজবও রটানো হয়েছিল।
তাই নিরাপত্তার কারণে অবস্থান পাল্টে আমি যাত্রাবাড়িতে যাই। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে কর্মসূচি ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিই- এ্যানিহাউ, আমি সেখানে উপস্থিত হবো। যদিও ওইদিন সকালেও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, তবুও আমার মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তে শহীদ মিনারেই থাকতে হবে। কারণ সেখানেই ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
৩ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু খাবার-দাবার খেয়ে রেডি হচ্ছিলাম। আর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমরা পুরো বাসার সবাইসহ একত্রে বের হয়েছি। তখন আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলাম। তো পুরো বাসার সবাই যখন বের হচ্ছিলাম, তালাটা আটকে আবার তালার দিকে তাকাচ্ছি। কারণ আর ফেরা নাও হতে পারে। আমাদের একটা সম্ভাবনা ছিল, আশঙ্কা ছিল এরকম যে আমাদের হয়তোবা শহীদ মিনার থেকে এ্যাটাক করা হতে পারে, শহীদ মিনার থেকে গ্রেফতার করা হতে পারে, কিংবা স্নাইপার শট হতে পারে। তখন অনেকগুলো জায়গায় স্নাইপার শট হয়েছে। কিন্তু বের হচ্ছিলাম খুব আনন্দে। মনে হচ্ছিল, ওকে, চেষ্টা করছি, শেষ সময়টা পর্যন্ত। এত ক্রাইসিসের মধ্যে এই মুভমেন্টে অংশ নিতে পেরে গর্ব ফিল হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওকে আমরা করতে পারছি। অনেকে এটা পারছে না, কিন্তু আমরা পারছি।
তখন রায়েরবাগের পুরো রাস্তাটা জ্যাম ছিল। স্টুডেন্টরা আটকে রেখেছিল ফ্লাইওভার এবং রাস্তাগুলো। তো আমি যখন আমার আইডি কার্ড শো করলাম এবং তখন আমাদের অলরেডি কোঅর্ডিনেটর প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে- আমি যখন পরিচয় দিলাম, তখন স্টুডেন্টদের মধ্য থেকে তারাই নিজেরা রাস্তা পুরো ক্লিয়ার করে, একজন সিএনজির সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তা খালি করে দিল। শহীদ মিনারে আসিফ ভাই ছিলেন। নাহিদ ভাই তখনও আসেনি।
সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তখনও অফিশিয়ালি এক দফার ঘোষণা হয়নি। কিন্তু মানুষের চোখে মুখে, আচরণে স্পষ্টভাবে এক দফা ঘোষণার ছাপ ছিল। সবার মুখে ‘এক দফা, এক দাবি, শেখ হাসিনা কবি যাবি- এই স্লোগান। শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে যদি আমি এখানে মারাও যাই, আমি সার্থক। আমি এখানে অংশ নিতে পেরেছি। এখানে আমার একটা অবদান আছে। কিছু করতে পেরেছি। এটার জন্য আমি সার্থক। মানুষ গিজগিজ করছে, একটা তিল ফেলার জায়গা নেই। গরমে, রোদে, বৃষ্টিতে জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে, তবুও মানুষের মুখে ক্লান্তি নেই। কারো কোনো ভয় নেই। পুলিশ গুলি চালাতে পারে, স্নাইপার শুট হতে পারে- সব জেনেও তারা দাঁড়িয়ে আছে। একদম আত্মার শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।
এরপর বাসায় ফিরে যাই। আম্মু প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমাদের স্টুডেন্টদের এক দফা বা পদত্যাগের দাবির মুখে কি সে (শেখ হাসিনা) চলে যাবে?’ তখন আমার মনে হয়েছিল, সে যাবে না, এটা আমরা জানি। স্বেচ্ছায় যাবে না, এটা আমরা আরও ক্লিয়ারভাবে জানি। কিন্তু আমি আজকে শহীদ মিনারে যে মানুষের ঢল দেখেছি— এরা কেউ বাঁচার জন্য সেখানে আসেনি, এরা সবাই মরতে এসেছে। এত মানুষকে, মানুষের রক্তের উপর পা ফেলে যদি সে থাকতে পারে, তাহলে আমরা জানতে চাই- শেখ হাসিনার হাতে কত বুলেট আছে। আমরা দেখতে চাই, তারা কত রক্ত দেখতে পারে। তারা কতদূর যেতে পারে। হাসিনার পতন নিশ্চিত। কারণ, শহীদ মিনারে এক দফায় আমি যেটা দেখেছি- ওই মানুষগুলোকে এই এক দফা ব্যতীত ঘরে ফেরানো কোনোভাবেই সম্ভব না।
বাসস : অনেকেই মনে করেন ৯ দফার মধ্যেই এক দফা ছিল। আপনার কি তাই মনে হয়?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : আমাদের ৯ দফা আসলে কেবলমাত্র কিছু দাবি নয়, বরং এক ধরনের কৌশল ছিল। আল্টিমেটলি যদি কেউ ৯ দফাকে কাটছাঁট করতে চায়, তাহলে দেখা যাবে একদফা অলরেডি ৯ দফার ভেতরে ঢুকে আছে। প্রথম দফা ছিল, সকল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া। এখন এই ‘ক্ষমা চাওয়া’ মানেই তো দায় স্বীকার করা, আর দায় স্বীকার মানেই চলে যাওয়া। কারণ কেউ যদি এই ধরনের দায় নেয়, তাহলে তাকে পদে থাকতে দেওয়া যায় না। কাজেই, এক অর্থে এটা একটা ট্র্যাপ ছিল। খুব হিসাব করে সাজানো এক ধরনের ফাঁদ। আমরা জানতাম, শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য এমন যে, উনি কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে সরাবেন না, কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন না এবং সবচেয়ে বড় কথা- উনি কখনোই ক্ষমা চাইবেন না। এই কারণেই ৯ দফা আসলে ছিল একদফায় পৌঁছানোর পথ। আমরা জানতাম, ৯ দফা থেকেই যদি সামনে যাওয়া হয়, তাহলে বিকল্প একটাই- এক দফা। নয় দফা মানলে হাসিনার পদত্যাগ আসবে, আর তিনি সেটা কখনোই করবেন না। আমরা এটাও জানতাম। তখনকার পরিস্থিতিতে এর চেয়ে কার্যকর আর কোনো দাবিই হতে পারত না। আর এ কারণেই আমরা বলি ‘ইট ওয়াজ এ ট্র্যাপ।’ সচেতনভাবে, পরিকল্পিতভাবে সেটাই করা হয়েছিল।
বাসস : আপনি কী মনে করেন এই আন্দোলনের ভিত গত ১৬ বছর শেখ হাসিনার স্বৈরাশাসনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : আমরা মনে করি, আমাদের প্রজন্মের এই আন্দোলন ছিল ১৬ বছরের বঞ্চনার ফল। কোটা আন্দোলন তার বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছিল ক্ষোভ, অপমান, অসম্মানের দীর্ঘ এক ইতিহাস। আমরা অবচেতনে এই ১৬ বছরের অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম। আন্দোলনটা ছাত্রদের হলেও, এটা শুধু ছাত্র আন্দোলন ছিল না। এটা এক পর্যায়ে গিয়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সেই ট্রানজিশনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেটা দুই তারিখের ‘দ্রোহযাত্রা’ এবং তিন তারিখের শহীদ মিনারে মানুষের ঢল দিয়ে স্পষ্ট হয়।
সিভিল সোসাইটির অংশগ্রহণ এখানে বড় ভূমিকা রাখে। প্রথম দিকে শিক্ষকরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে আন্দোলনে শরিক হন। পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এতে শরিক হন। আবার শহীদ মিনারে যাওয়ার বিষয়টিও একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তখন দেখা যায় যে আন্দোলন শুধু ছাত্রদের না বরং এর সাথে শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সাধারণ মানুষও একত্রিত হচ্ছে।
বাসস : ১৭ জুলাই আবাসিক হল বন্ধের পর আন্দোলন অনেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের অবদান কীভাবে দেখেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : ১৭ জুলাইয়ের পর ১৮ জুলাই বসুন্ধরা এবং উত্তরা এলাকা থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে রাস্তায় নামতে শুরু করে। ব্রাক, এনএসইউসহ সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুভমেন্টের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। এটি ছিল মুভমেন্টে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। কারণ, বাংলাদেশে এত বড় আকারে আরবান মিডল ক্লাসের সরাসরি অংশগ্রহণ আগে দেখা যায়নি। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, তাদের পরিবারের সদস্যরাও সেখানে ছিল। এটাকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি টিপিক্যাল মুভমেন্ট হিসেবে দেখা হয়।
সেদিন মুগ্ধ ভাই শহীদ হন, অনেক ছেলেমেয়ে আহত হয় এবং আরও কয়েকজন শহীদ হন। যদিও তখন তথ্যগুলো বেশি প্রচার পায়নি, আমরা জানতাম অনেকেই শহীদ এবং আহত হয়েছেন। এই শহীদ ও আহতদের পরিবার ও সোসাইটির মধ্যে ঘটনাগুলো ছড়িয়ে পড়ে, আর ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে আরবান মিডল ক্লাসের সংযুক্ততা ও অংশগ্রহণ বেড়ে যায়।
বাসস : অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। অনেকে এটাকে নারীদের আন্দোলন বলেও আখ্যা দিয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : জুলাই মাস জুড়ে নারীরা পিছিয়ে ছিল না, তারা অনেক সাহসীভাবে সামনে এগিয়ে এসেছিল। নারীরা বুক পেতে মিছিল করেছে। তারা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। নারীদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের জন্য একটি আশার কথা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত জুলাইয়ের পর মেয়েদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। অনেকেই ব্যক্তিগত বা পারিপার্শ্বিক কারণে দূরে সরে গেছে।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে কিছু বলুন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : এই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো নতুন মুখ, তরুণ নেতা, নতুন রাজনীতিবিদ উঠে এসেছে, যারা আগের সময়ে ছিল না। আগে রাজনীতিতে আসতে পারিবারিক পরম্পরা এবং দীর্ঘ সময় লাগত। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণরা সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য একটি ঘটনা।
বাসস : গণঅভ্যুত্থানের পর সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পেরেছেন কি?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : এখনও পুরোপুরি কাজ করতে পারেনি। তবে মানুষের মধ্যে সংস্কারের প্রতি সচেতনতা বেড়েছে। জনগণের সমর্থন থাকায় এখন সংস্কার আনা কিছুটা সম্ভব হয়েছে, যা আগে সম্ভব ছিল না। তরুণদের রাজনীতিতে আসার প্রবণতাও বেড়েছে, যা আগের সময় ছিল না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। মানুষ ত্যাগ স্বীকার করে, শহীদ হয়েছে দেশের জন্য। আমাদের আশা থাকবে এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে দেশের সংস্কার সম্ভব হবে, যা গণআন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল।